এক নিঃসঙ্গ মানুষের অন্তদ্বন্বের কাহিনী – প্রমিথিউস
সম্প্রতি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সৌভিক গাঙ্গুলী প্রযোজিত স্বল্পদৈঘ্যের কাহিনী। এই ১১ মিনিটের চলচ্চিত্রে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ তার মনের ভিতরে থাকা অন্তরাত্মার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলে, সেই কাহিনি দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
চলচ্চিত্রের দারুন সিনেমাটোগ্রাফি, অভিনয়ের নৈপুন্যতা ছবিটিকে পরিপূর্নতা দিয়েছে।
গ্রীক পুরান অনুসারে প্রথিমিউস ছিলেন একজন টাইটান যাকে মানুষের সবথেকে উপকারী বন্ধুও বলা যায়। জিউস ক্ষমতাবলে প্রথিমিউস ও এপিমিথিউস দুই ভাইকে বিশ্বজগত সৃষ্টির দায়িত্ব দেন। পৃথিবীতে এসে প্রথিমিউস ও তার ভাই বিভিন্ন স্থানে মাটি নিয়ে বানাতে থাকলেন বিভিন্ন প্রানী। প্রমিথিউস আগে ভেবে তারপর গড়তেন তাই তার নামের আগে ‘প্র’ অর্থাৎ আগে শব্দটি যুক্ত ছিল। এপিমিথিউসের মত সাধারন পশু পাখি তিনি বানাতেন না বরং আরও উন্নত কিছু বানানোর চেষ্টায় থাকতেন। এরপর পৃথিবীর সবথেকে উৎকৃষ্ট মাটি ও স্বচ্ছ পানিতে মাটি গলিয়ে তিনি নতুনপ্রানী সৃষ্টি করেন এবং তাদের দেবতার আকৃতি দেন। এই নতুন সৃষ্টির নাম দেন মানুষ। মানুষ বানানো হয়ে গেলে তিনি অলিম্পাসে যান ও সেখানে তিনি জ্ঞানের দেবীকে অনুরোধ করেন তার সৃষ্টিতে প্রানদান করতে। প্রমিথিউসের অনুরোধে দেবী মর্তে এলেন ও মানুষের শরীরে ফু দিয়ে প্রানসঞ্চার ঘটালেন। জিউস যখন সকল আগুন নিয়ে গেছিল তখন এথেনার কারএকটি নৌকা দুলছে।খানা ও হেফেস্টাস থেকে আগুন চুরি করে আনেন তিনি। প্রমিথিউসের আগুন মানবসভ্যতার দ্রুত বিকাশ ঘটাল।
এবার ফিরে আসি চলচ্চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে। নির্মাতা তার সৌন্দর্য দর্শন দিয়ে সুকৌশলে প্রথিমিউসকে বানিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে যাদু বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছেন।
চলচ্চিত্রের শুরুতে দেখা যায় মূল চরিত্র বসে আছেন বহমান নদীর মাঝে উত্তাল গঙ্গায় মাঝেI নদী যখন বহমান হয় তখন চরিত্রটি হয় সময়ৃর সঙ্গে ভাসমান নৌকা।
এরপর চরিত্রটি যখন আগুন জ্বালিয়ে বিড়ি ধরাতে থাকে, তখনই সামনে এসে উপস্থিত হয় প্রথিমিউস যে কীনা মানব সভ্যতার জন্য আগুন পর্যন্ত চুরি করেছিলেন। চলতে থাকে দুটি চরিত্রের নানা সংলাপ। বাহিরের সত্বা ও ভিতরের সত্বার অন্যরকম বক্তব্যে ক্রমশ জোরালো হয় অন্তদ্বন্ব।
স্মৃতির পাতা উলটে চলে আসে সুপর্নার কথা। তাকে ঘিরে কত মধ্যবয়সী স্মৃতি, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি। তবে সেলফি তোলা ও খাটে তোলা বিষয়টি নারীবাদী বোদ্ধাগন কীভাবে নেবেন, গঙ্গার ঢেউর অনুভূতি ঠিক কী রকম হবে তা অবশ্য বলা কঠিন। তবে একজন সাধারন দর্শক সমালোচক হিসেবে আমার মনে হয়েছে এটি একজন নির্মাতার স্বাধীন সত্বার বহিঃপ্রকাশ, ষ্পষ্ট্যভাষ্যেরও কিছু দরকার আছে।
চলচ্চিত্রের চরিত্রটি পাখির মত পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু পালাতে পারে না। বরং একজন ব্যর্থ প্রেমিক হওয়ার থেকে ব্যর্থ পুরুষ হওয়ার চেষ্টা করে। সে ভাবে তার বাবার কথা, তার স্বপ্ন। কিন্তু জেনারেশন থেকে পরবর্তী জেনারেশনের চিন্তাভাবনা গুলো আলাদা। পূর্বপুরুষের ইগোর কাছে নতুন প্রজন্মের তাজা কচি স্বপ্নগুলো যে উপেক্ষিত থেকে যায় তা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন সৌরভ গাঙ্গুলি।
প্রসঙ্গক্রমে আসে ভোটের কথা, রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। উঠে আসে মন্টাদার কথা।
আবার গ্রীক পুরানে ফিরে গেলে দেখতে পাব, দেবতাদের কতটা উৎসর্গ করা হবে আর কতটা মানূষের ভাগে থাকবে তার জন্য মিসোন নামক স্থানে অনুষ্ঠান করেন প্রমিথিউস। এটি ট্রিক মিসোন নামেও পরিচিত।
আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক বেশী অভিভূত হয়েছি। ভাবছি কথোপকথনগুলোকে Dialogue না monolouge বলব, প্রকৃতপক্ষে চরিত্রটি নিজে নিজের সঙ্গে কথা বলছিল।
তবে সমালোচনার খাতিরে এটাই বলব, চিত্র জুড়ে সংলাপ আর সংলাপ এত কথা। নীরবতার অনুভূতিখে মিস করেছি। পরিচালক এই মাত্রতিরিক্ত সংলাপের পরিবর্তে তদি মিউজিক আর ছবি দিয়ে কিছু মুহুর্ত করতে পারতেন তাতে দর্শকরা আরও বেশী অনুভব করতে পারতেন। সিনেমাটা আরও সিনেমেটিক হয়ে উঠত।
বহমান জীবনের আনাচে কানাচে অনেক না বলা স্বপ্ন থাকে।কখনও তা জলের স্রোতের ন্যায় বয়ে যায়, কখনও আগুনের ন্যায় জ্বলে ওঠে। আর এমনই কাহিনীকে শর্ট ফিল্মে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন সৌভিক গাঙ্গুলি।
১১ মিনিট ৫ সেকেন্ডের এই শর্ট ফিল্মে অভিনয় ঈরেছেন সবুজ বর্ধন ও শুভজিৎ দাস। ছবির সামান্য ঝলকই সামনে এসেছে যেখানে রয়েছে একটি চরিত্র ও তার অন্তঃসত্বা। আর এই সত্বাকেই প্রথিমিউসের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সৌভিক গাঙ্গুলী। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সাফল্য – ব্যর্থতা, প্রেম – অপ্রেম, আশা – নিরাশা সত্বা গুলি একই সঙ্গে বয়ে চলে নদীর স্রোতের মত। এই শর্টফিল্মে রাজনৈতিক আশা আকাঙ্খার পথও দেখিয়েছেন তিনি।
স্বল্প দৈঘ্যের এই ফিল্মে ক্যামেরার দায়িত্বে আছেন স্বাগতম করাতি ও উদয়ন মজুমদার। সম্পাদনায় অর্পন বৈদ্য। সিনেমাটি দেখার জন্য কোন হলে অবশ্য আপনাকে যেতে হবে না। স্মার্টফোনে মাই সিনেমা হল অ্যাপটি নামিয়ে মাত্র তিরিশ টাকার বিনিময়ে আপনি উপভোগ করতে পারবেন ১১ মিনিট ৫ সেকেন্ডের এই শর্টফিল্ম।